বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫, ১০:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
শিরোনাম :

বাজেটের ভাষা বাস্তব, কাঠামো পুরনো: বাংলাদেশের অর্থনীতির সন্ধিক্ষণে

নিউজ ডেস্ক | মেট্রোটাইমসটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট : মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫, ১:২৬ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পেশ করা হয়েছে, যখন দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই বাজেটে অর্থ উপদেষ্টার একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়েছে—বিশেষ করে বাজেট বক্তৃতায় যে ভাষা ও ভঙ্গিতে দেশের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, তা অনেকাংশেই আগের সরকারের আমলাতান্ত্রিক বক্তব্যের তুলনায় বাস্তবমুখী ও জবাবদিহিতার ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি যেভাবে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং আঞ্চলিক ও শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো চিহ্নিত করেছেন এবং এগুলোর সমাধানে সরকারকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। এতে বোঝা যায়, তিনি বাজেটকে শুধুই রাজস্ব ও ব্যয়ের সমন্বয় হিসেবে না দেখে একে একটি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

তার বক্তৃতায় স্বীকার করা হয়েছে যে দেশের অর্থনীতি একটি চাপগ্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য দুঃসহ হয়ে উঠেছে। এছাড়া, নতুন কর্মসংস্থানের ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে আস্থাহীনতা—এসব বিষয়ও তিনি তুলে ধরেছেন।

এভাবে বাজেটের মাধ্যমে বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার যে প্রচেষ্টা, তা দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে তাঁর সদিচ্ছা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অন্তত কৌশলগত উপলব্ধির ইঙ্গিত মেলে।

তবে বাজেট বক্তৃতার ভাষাগত বাস্তবতা ও রাজনৈতিক সততার পেছনে যে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, সেটি অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। বাজেটের প্রস্তাবনা ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি মূলত আগের বছরের বাজেট কাঠামোরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। এতে কিছু নতুন উদ্যোগ থাকলেও পুরনো সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রাম দেখা যায় না।

বহুদিন ধরে চলে আসা রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, সরকারি ব্যয়ের অদক্ষতা, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা—এই সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধানে কোনও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ বা সংস্কারের অঙ্গীকার নেই। এতে প্রমাণ হয়, বাজেটের ভাষাগত শক্তি থাকলেও বাস্তব কাঠামোগত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি এখনও পরিপক্ক নয়।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যেসব জনসম্পৃক্ত দাবি সামনে এসেছিল, তার মধ্যে ‘বৈষম্য হ্রাস’ ও ‘যোগ্য কর্মসংস্থান’ ছিল মুখ্য। আন্দোলনটি সামাজিক ন্যায়বিচার, যুবকর্মসংস্থান এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়নের দাবি নতুন করে আলোচনায় এনেছিল। এবারের বাজেটে সেই দাবির কিছু প্রতিফলন দেখা গেলেও তা একদিকে খণ্ডিত, অন্যদিকে বাস্তবায়নের দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোনও কাঠামোগত পরিবর্তন নেই এবং তাতে যা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বরাদ্দ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সমস্যা যেমন দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। তদুপরি, এই খাতগুলোর কাঠামোগত সংস্কার—যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মানবসম্পদ উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা, এবং তথ্য-ভিত্তিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা—এসবের অভাব স্পষ্ট।

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য বাজেটে কিছু ইতিবাচক ঘোষণা যেমন শিল্পে প্রণোদনা, এসএমই খাতে সহায়তা, এবং প্রযুক্তিনির্ভর খাতকে উৎসাহিত করার প্রস্তাব থাকলেও, মূল কাঠামোগত সমস্যা—যেমন কর প্রশাসনের জটিলতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের অভাব, আমদানি-রফতানিতে অস্বচ্ছতা এবং বিচারব্যবস্থার ধীরগতি—এসব বিষয়ে কার্যকর কৌশল অনুপস্থিত। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য যে ধরনের নীতিগত স্থিতিশীলতা ও রেগুলেটরি সংস্কার প্রয়োজন, তা এই বাজেটে অনুপস্থিত। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য উদার নীতি, এক্সিট পলিসি, এবং ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার যে কথাগুলো আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত, সে দিকেও বাজেট নীরব থেকেছে।

বাজেট বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়েও বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দের সমন্বয়, এবং ব্যয়ের স্বচ্ছতা—এই তিনটি ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এবারের বাজেটে এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য কোনও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ, সময়বদ্ধ কর্মপরিকল্পনা বা জবাবদিহিতামূলক মেকানিজম দেখা যায়নি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রকৃত কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য যেসব মূল্যায়ন কাঠামো দরকার, যেমন ফলাফলভিত্তিক বাজেটিং, পারফরম্যান্স অডিট—এসবের বিষয়েও বাজেট নিরব। ফলে বাজেট আবারও পরিণত হয়েছে একটি অঙ্কভিত্তিক অনুশীলনে, যেখানে বৃহৎ অর্থনৈতিক রূপান্তরের রাজনৈতিক কল্পনা অনুপস্থিত।

এই প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন সামনে এসেছে—বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আসলে কতটা আন্তরিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে? নাকি রাজনৈতিক সংকট, নির্বাচন-পরবর্তী অনিশ্চয়তা, এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অসহযোগিতার ব্যবস্থাপনাই তাদের মূল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে?

গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্ক, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সরকারকে একটি চাপে ফেলেছে। এই চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে যদি সরকার অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোকে উপেক্ষা করে শুধুই রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকেই মনোযোগ দেয়, তাহলে তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

সামগ্রিকভাবে বললে, এখন সময় এসেছে অর্থনীতির প্রতি সমান অগ্রাধিকার প্রদানের। জনগণের আস্থা অর্জন এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে একইসঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে সামনে এগোতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয়ের বৈষম্য হ্রাস, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ—এই চারটি ক্ষেত্রকে ঘিরে একটি স্পষ্ট কৌশলগত রূপরেখা তৈরি না হলে, বাজেট কেবল একটি প্রশাসনিক কার্যক্রমে পরিণত হবে। সরকার যদি এ সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়, তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ভবিষ্যতে একটি ব্যর্থ সম্ভাবনার নিদর্শন হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পাবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সানেম (সুত্র; বাংলা ট্রিবিউন)

 


এই ক্যাটাগরির আরও সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর