শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১২:৪৬ অপরাহ্ন

গত ১০ মাসে ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও ২৩ শতাধিক ব্যাংক একাউন্ট অবরুদ্ধ দুদকের

নিউজ ডেস্ক | মেট্রোটাইমসটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট : বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫, ৫:৪৮ অপরাহ্ন

গতবছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। টানা ১৬ বছর গণতন্ত্রের লেবাসে জগদ্দল পাথরের মতো স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে বসে থাকা একদলীয় ও একনায়কের পতন ও পলায়নের পর দুদক কর্মকর্তরাও যেন নড়েচড়ে বসেছেন। 

তারা একের পর এক মামলার তদন্তে নেমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, বিদেশে পাচার, একেকটি শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যাংকে শতাধিক  হিসাবের লেনদেন, মানিলন্ডারিং, জমি, প্লট, মৎস্য ঘেরের নামে দুর্নীতির পাহাড় তৈরী, বিদেশে প্লট, ফ্ল্যাট দেখে রীতিমতো বোকা বনে যাচ্ছেন।

কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ‘দেশের মানচিত্রের খোলস আছে, ভেতরে সব খেয়ে সর্বনাশ করেছে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা’।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গত ১০ মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) ১২৮টি কোর্ট আদেশের মাধ্যমে  বিভিন্ন জনের নামে দেশে থাকা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করেছে।

এছাড়া বিদেশে থাকা প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সম্পদ যেন আইনী প্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তগত করা যায় সেজন্য অবরুদ্ধ আদেশ নিয়ে রেখেছে।

দুদকের গত ১০ মাসের তথ্য বলছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের দোসর ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেফতার এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করে দুদক তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সফলতা দেখিয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থান ও পরবর্তী ২০২৪ এর আগস্টে পতিত সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকে গত ১০ মাসে দায়েরকৃত মামলা, দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর – অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধের জন্য আদালত কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, বিভিন্ন জনের নামে সহস্রাধিক ব্যাংক একাউন্টে  থাকা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার স্থিতি, বিভিন্ন শেয়ার, ইউএস ডলার, ইউরো অবরুদ্ধ করার এই চিত্র পাওয়া গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত মামলা ও সম্পদ জব্দের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক, ভাগিনা রেজোয়ান সিদ্দিক ববি রয়েছে।

শেখ হাসিনাসহ শেখ পরিবারের ছয় সদস্যের নামে পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেয়াসহ রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্জিত সম্পদ ক্রোক ও তাদের ব্যাংক একাউন্ট আদালতের নির্দেশে অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

এই তালিকায় আরো রয়েছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ), তার স্ত্রী রুখমিলা জামান। শুধুমাত্র সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী’র নামেই  বিদেশে ৫৮২টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।  সালমান এফ রহমান, আলোচিত ব্যাংক দখলদার ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম (মাসুদ), তার স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের নামে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে আত্নসাৎ করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রীর রয়েছে বিপুল সম্পদ। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, এডভোকেট কামরুল ইসলাম, জুনায়েদ আহমদ পলকসহ অনেক আওয়ামীলীগ নেতার রয়েছে সম্পদের পাহাড়। এদের মধ্যে আরো রয়েছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, আমলা এবং  তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্নীয় স্বজন।

এছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছে ব্যাংকার নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমদ ও তার স্ত্রী, দুই মেয়ে, সাবেক দুই আইজিপি শহিদুল হক ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ফেনীর আলোচিত সাবেক এমপি নিজাম হাজারী ও তার স্ত্রী, যশোরের সাবেক এমপি রনজিত কুমার রায়, তার স্ত্রী ও তিন পুত্র। দুদকের দায়েরকৃত মামলায় ৪৯৮ জন হেভিওয়েট সরকারী চাকুরীজীবী, বে-সরকারী চাকুরীজীবী, রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী -এমপি, জনপ্রতিনিধি ও তাদের দোসর ব্যবসায়ী রাজনীতিক, আমলা, পরিবারের সদস্যসহ মোট আসামীর সংখ্যা প্রায় ১৮ শতাধিক। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলার পাশাপাশি আদালতের মাধ্যমে আরো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশনা পাচ্ছে এবং নতুন অভিযোগ তদন্তের অনুমোদন দিচ্ছে দুদক।

জুলাই বিপ্লবের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ১০ মাসে ১৬ বছরের অলিখিত নির্দেশনামা থেকে বের হয়ে এখন স্বাধীন সত্তায় আর্বিভূত হয়েছে। সরকার ও অন্যান্য সংস্থার চাপমুক্ত থেকে কাজ করায় দুদক ইতোমধ্যে পাঁচশ’রও বেশি তদন্ত, চারশ’রও বেশি চার্জশীট, সাড়ে তিনশ’রও বেশি এফআইআর ও ৫০ টি চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে।

দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত সাড়ে ছয়শ’রও বেশি মামলার অনুসন্ধান করা হয়েছে। চার্জশীট হয়েছে তিনশ’রও বেশি। এসব মামলার প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল জ্ঞাত উৎস বর্হিভূত আয়, মানি লন্ডারিং, ঘুষ লেনদেন। জাল জালিয়াতির দায়ে জানুয়ারী মাসে ২৩৮ জনের বিরুদ্ধে ৭০টি এফআইআর (এজহার), ৭১ জনের বিরুদ্ধে ২৮টি চার্জশীট দেয়া হয়েছে। ২৭ জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। ৯৬ টি নতুন অনুসন্ধান ও ৩৩ টি সম্পদ বিবরণীর আদেশ অনুমোদন দিয়েছে কমিশন ।

ফেব্রুয়ারী মাসে ১৫৮ জনের বিরুদ্ধে ৫৪টি এফআইআর, ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে ৫২টি চার্জশীট, ৯৫টি নতুন অনুসন্ধান, ৫৭টি সম্পদ বিবরণী ও আদেশ অনুমোদন করেছে কমিশন। মার্চ মাসের  তথ্যে দেখা যায়, ৮১ জনের বিরুদ্ধে ২৯টি এজাহার, ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে ৫২টি চার্জশীট এবং ১০১টি নতুন অনুসন্ধানসহ ১৯টি সম্পদ বিবরণীর আদেশ অনুমোদন করেছে।

গত ১০ মাসে দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত এসব মামলায় ৪৭০ একর জমি, ৪০ টি বাড়ি, ৭০ টি ফ্ল্যাট, ৩১টি প্লট,  ৯টি দোকান, ২৮ টি গাড়ি, ৩টি জাহাজ, ১টি ট্রাক, ৫২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ৩ টি কোম্পানি এবং ২ হাজার ৩৪৬টি ব্যাংক একাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টগুলোতে সর্বমোট ২ হাজার ৭০৬ কোটি ৩২ লাখ ৩৫ হাজার ১৩২ টাকা স্থিতি রয়েছে। বিদেশে ২৩টি কোম্পানির নামে  ৮ লাখ ৮৮ হাজার ৪৭৪ ডলার এবং ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৪৮০ ইউরো ও ৫৮২টি ফ্ল্যাট এবং বাণিজ্যিক স্পেস অবরুদ্ধ করার আদেশ নেয়া হয়েছে । এছাড়াও বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে ৭ লাখ ১৩ হাজার ৯৪০ ডলার ও ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮০ ইউরো স্থিতি রয়েছে।

গত ২০২৪ এর আগস্ট থেকে ২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দুদকের প্রাথমিক হিসেবে দেখা যায়, যেসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে দেশে থাকা স্থাবর সম্পদ ৮২৪ কোটি ২৩ লাখ, ৪০ হাজার টাকা, অস্থাবর সম্পত্তি ১১ হাজার ৪৭৪ কোটি ৮৪ লাখ  টাকা। বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ১২০ কোটি ৭৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা এবং বিদেশে অস্থাবর সম্পত্তি ৪৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

দুদকের বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ‘অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র সংস্কারের প্রধান আলোচ্য ইস্যু দুর্নীতিকে নির্মূলের যে সর্বজনীন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার ওপর আস্থা রেখে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে দুদক। মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট দুদক প্রধান কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন উপ-পরিচালক বাসস’র সাথে আলাপকালে এসব তথ্য দেন।

তারা বলেন, একসময় দুদককে  বিদ্রুপাত্নক  ভাষায় ‘দন্তহীন বাঘ’ বলা হতো। জুলাই বিপ্লবের পর সরকার ও কোন সংস্থার হস্তক্ষেপ নেই দুদকে। অতীত সরকারের মতো ফরমায়েশি নিবর্তনমূলক মামলাও নেই। আশা করছি এভাবে চলতে থাকলে কেউ আর দুদককে ‘দন্তহীন বাঘের’ সাথে তুলনা করার সাহস পাবে না।

দুদক জানায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির বিভিন্ন নেতাকর্মী ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের এসব সম্পদ আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। যেসব সম্পদ বিদেশে আছে প্রকৃত অর্থে সেসব সম্পদ দুদকের নিয়ন্ত্রণে কতটুকু আসবে তাতে কিছুটা সন্দেহ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার আদালতের রায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে রাষ্ট্র পর্যায়ে ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা করে সিদ্ধান্তে যদি পৌঁছাতে পারে সেক্ষেত্রে ফলাফল আসতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড.কাজী আকতার হামিদ বাসসকে জানান, ক্ষমতা হচ্ছে রাষ্ট্রের দেয়া আমানত। সেই রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যারা দেশ পরিচালনায় জনগণের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠে তারা বা তাদের পরিবার দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রকে তা অত্যধিক গুরুত্বের সাথে তদন্তে নেয়া উচিত। সরকারের দায়িত্ব ও সততার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে যথেচ্ছার ব্যবহার করে অন্যায়, অবৈধ এবং তথ্য গোপনের মাধ্যমে দুর্নীতিকে পারিবারিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সারাদেশে ঘৃণা ও ধিক্কারের আওয়াজ উঠেছে।

ড. আকতার হামিদ বলেন, ইতোমধ্যে তদন্ত  ও অনুসন্ধানে যেসব অভিযোগ এসেছে এবং মামলা রুজু হয়েছে তা ভয়ানক। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা স্তম্ভিত। জাতি হিসেবে আমরা ভাবি নাই শেখ পরিবার এমন ভয়ানক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে পারে।  শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তদন্ত করা প্রয়োজন। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের নীতির প্রতি যথাযথ সম্মানের সাথে তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি আনতে হবে।-বাসস


এই ক্যাটাগরির আরও সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর