শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে সারাদেশ থেকে ছাত্র-জনতাকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ নিহত এবং সরকারদলীয় কর্মী ও পুলিশের যৌথ দমন অভিযানের কারণে এ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়।
রাজধানীর শাহবাগে বিকেল ৩টার দিকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের দলীয় ক্যাডারদের রাস্তায় নামিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক- বিজয় ছাড়া কিছু নয়। আমরা এখনো সময় দিচ্ছি। সরকার যদি সহিংসতা চালিয়ে যেতে থাকে, আমরা জানিয়ে দিতে চাই, আমরা গণভবনের দিকে তাকিয়ে আছি।’
এদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে নিহতদের মরদেহ নিয়ে মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি ঢামেক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত যায়। মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা ‘আমার ভাই মরলো কেন, শেখ হাসিনা জবাব চাই’, ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
মিছিল শাহবাগ থানার সামনে পৌঁছানোর পর পুলিশ দাবি করে, কিছু আন্দোলনকারী থানায় ইটপাটকেল ছুঁড়েছে। এর পরপরই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে।
এর আগে, ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা দেন। সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে ছাত্র-জনতার প্রতি ১৫টি নির্দেশনা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তত ২০টি জেলায় সরকারপন্থী কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বিরোধী দলের আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। সহিংসতা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন।
রাজধানী ঢাকায় অন্তত ১২ জন নিহত হন। তাদের অধিকাংশকে মৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
দেশজুড়ে উত্তাল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সরকার দেশব্যাপী কারফিউ জারি ও ফোর-জি মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সরকার ৫ আগস্ট থেকে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে।
১৬ জুলাই সারাদেশে ৬ জনকে হত্যার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এরপর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মোট ৩১১ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
৪ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, ধানমন্ডি-২৭, মিরপুর-১০, উত্তরা, রামপুরা ও বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, দিনমজুর, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা অংশ নেন।
ঢাকার বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারদলীয় সমর্থক ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়।
শাহবাগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ভবনে আশ্রয় নেয়। এ সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অন্তত ২৪টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
ঢাকার বাইরে লক্ষ্মীপুরে অন্তত আটজন, ফেনীতে আটজন, রংপুরে চারজন, বগুড়ায় পাঁচজন, সিলেটে চারজন, পাবনায় তিনজন, মুন্সিগঞ্জে তিনজন, মাগুরায় চারজন, কিশোরগঞ্জে তিনজন, কুমিল্লায় তিনজন নিহত হন।
ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ) কার্যালয় ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় জেলার কোতোয়ালি থানা আক্রান্ত হলে পুলিশ গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।
৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় বলা হয়, রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা সদর, উপজেলা সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও শিল্পাঞ্চলে সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বলবৎ থাকবে। তবে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, ৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ জারি হলেও চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মুন্সিগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ফেনী, রংপুর, ময়মনসিংহ, জয়পুরহাট ও ভোলায় আন্দোলন অব্যাহত থাকে।
এর আগে, ১৯ জুলাই মধ্যরাতে সরকার প্রথম অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করেছিল, যা মাঝে মধ্যে শিথিল করা হয়েছিল।
৪ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘অবৈধ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’-এর নিন্দা জানায়।
টিআইবি জানায়, সম্পূর্ণ অহিংস, অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনকে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং যারা এ নিপীড়নের আদেশ ও অনুমোদন দিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪ আগস্ট বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করে। এতে শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া চালুর আহ্বান জানানো হয়।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রস্তাব তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
সেই প্রস্তাবে বলা হয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সেই সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
এদিন হাইকোর্ট আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো বন্ধের আবেদন জানিয়ে করা একটি রিট খারিজ করে দেন। আদালত জানান, দায়িত্ব পালনের সময় প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগ করতে পারে।