বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:২৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
শিরোনাম :
সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গুজব অনেকটা কমেছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম স্ত্রীসহ অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সেলিম মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জয়, পুতুল ও ববিসহ ৮ জনের নামে মামলার অনুমোদন পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ১৭৪৮ জন ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু ঢাকা জেলার আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্সসমূহ ২০২৬ সালের জন্য নবায়নের সময় নির্ধারণ ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫’ এর খসড়া প্রকাশ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দিলো ডিএমপি নিউজার্সির প্রথম নারী গভর্নর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়লেন শেরিল ভার্জিনিয়ার প্রথম নারী গভর্নর হয়ে ইতিহাস গড়লেন অ্যাবিগেল

জরুরি অবস্থা ঘোষণা হলে, সশস্ত্র প্রতিরোধ করা হতো : আদীব

বাসস মেট্রোটাইমসটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট : সোমবার, ৭ জুলাই, ২০২৫, ৪:৩৬ অপরাহ্ন

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেপথ্যের সংগঠক আরিফুল ইসলাম আদীব; বর্তমানে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আদীবের জন্ম ১৯৯৬ সালে ১১ নভেম্বর বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে। লেখাপড়া করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে জাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে তার সাংগঠনিক পথচলা শুরু। ২০১৯ সালে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক ছিলেন। ২০২৩ সালে ১৬ ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ের গঠিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ক ছিলেন। এছাড়া ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পেশাগত জীবনে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে কাজ করেছেন আদীব। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ও মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কয়েকবার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আদীব। ২০১৯ সালে ডাকসু ভবনে তার ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের সংগঠক হিসেবেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর বিশেষ আয়োজনে মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। নিম্নে তার সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো-

বাসস : প্রথমে জুলাইয়ের এমন স্মৃতি শুনতে চাই যা এখনো কাউকে বলেননি?

আদীব : জুলাই আন্দোলন নিয়ে এখনো বলা হয়নি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি হচ্ছে ১৬ জুলাই ও ৫ আগস্ট দুপুরের সময়। প্রথমে ৫ আগস্টের কথা বলি। দুপুর ১২টার দিকে আমাকে ফোন করলো বর্তমান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। ফোন করে বললো ভাই সেনাবাহিনী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করতে পারে বিপরীতে আমরা বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করতে চাই। আপনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের নিয়ে আসেন, আমরা চানখারপুল আছি। এখানে উল্লেখ্য ২ আগস্ট আসিফ মাহমুদের সাথে রাতে অনলাইনে আমার কথা হয়েছিল, হাসিনার বিদায় হলে সংসদ ভবন বা গণভবন জনতা দখল করলে আমরা বিপ্লবী সরকার করবো, এর নাম হবে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ (রেভ্যুলেশনারী ন্যাশনাল গভমেন্ট)।

তিনি বলেন, ২ আগস্ট থেকে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের নাম্বার সেদিন থেকে আমার ফোনে এখনো সংক্ষেপে আরএনজি নামে সেভ করা। ৫ আগস্ট দুপুরে আসিফের ফোন পাওয়ার সাথে সাথে আমি ও নেত্র নিউজের সাংবাদিক এহসান মাহমুদ রিক্সায় করে সরাসরি চানখারপুল চলে যাই। গিয়ে সেখানে আমরা তিনজন শহীদের লাশ দেখতে পাই। আসিফ মাহমুদ, মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আরও অনেকেই সেখানে ছিলেন। আমি বিবিসির আকবর ভাই ও রয়টার্সের স্যাম ভাইকেও সাথে সাথে জানাই যদিও তারা পৌঁছাতে পারেননি। চানখারপুলে তখনো খুনি হাসিনার পুলিশ গুলি করছিল। জনতা দুপুর ১টার কিছুক্ষণ পরে আমরা চানখারপুল মেইন রাস্তায় উঠতে পারি। এরপর আমরা মিছিল নিয়ে ঢামেক, শহীদ মিনার টিএসসি হয়ে শাহবাগ পৌঁছাই। আমরা যখন শাহবাগ পৌঁছে যাই তখনও ওখানের কারো জানা ছিল না যে গণভবন দখল হয়েছে কিনা। যেহেতু সেনাপ্রধান ভাষণ দিবেন, কিছু একটা হচ্ছে সবাই বুঝছিলাম কিন্তু সঠিক তথ্য আসেনি। একইসাথে আমাদের এই আশংকা ছিল যে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন এবং ক্ষমতা দখল হতে পারে। আমরা সেটারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে, যদি জরুরি অবস্থা হয় তাহলে বিপ্লবী সরকার ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। দুপুর ১টার দিকে আসিফ মাহমুদের একটি ভিডিও রেকর্ড করা ছিল। শাহবাগ পৌঁছালে সেখানে সহযোদ্ধা নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার, তারিকুল ইসলাম, লুৎফর রহমান, আসাদ বিন রনিসহ অভ্যুত্থানের অনেক নেতৃত্বকে একসাথে পাই। সেখানে নাহিদ ইসলাম একটি বক্তব্য রাখেন। কিন্তু সেখানে কোন গণমাধ্যম ছিল না। এরপর বিপ্লবী জনতা একসাথে গণভবনের দিকে রওনা হয়। নাহিদ, আসিফ, বাকের ও তারিকুলকে একটি রিক্সায় তোলা হয়। রিক্সাটি জনতা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে আমরা বাংলামোটর, কাওরানবাজার, ফার্মগেট হয়ে সংসদ ভবন পৌঁছাই। পুরো রাস্তায় এতো মানুষ ছিল যে হাঁটাই সম্ভব ছিল না। মানুষ এসে নাহিদ আসিফকে ছুঁয়ে দেখতে চাইতো। অনেকে কান্না করে দিত। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সংসদ ভবন পৌঁছে নাহিদ ইসলাম ৪ মিনিটের একটি বক্তব্য দেন, সেখানেও আসলে কোন গণমাধ্যম ছিল না, মাইকও ছিল না। ফলে আমরা ৫ জন (নাহিদ, আসিফ, বাকের, তারিকুল ও আমি) সিদ্ধান্ত নিই- যে কোনভাবে হোক একটি গণমাধ্যমে আমাদের পৌঁছাতে হবে। শেখ হাসিনা পালিয়েছে কিন্তু এখন কি হবে সেটা নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম আমরা। আমরা সংবিধান বাতিল ঘোষণা করে বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করতেও চেয়েছিলাম। একই সাথে যেহেতু সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন এই ঘোষণা ছিল, ফলে জরুরি অবস্থা জারি হয়ে সেনাশাসন হতে পারে সেই আশংকাও করছিলাম। সংসদ ভবন এরিয়ায় ফোনে নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত না, পুরো পরিস্থিতি বোঝা মুশকিল ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক সেনাপ্রধানের ভাষণের আগেই আমাদের জাতির সামনে হাজির হতে হবে। অন্তত একটি গণমাধ্যম হলেও লাইভে যেতে হবে। পুরো জাতি আসলে অধীর আগ্রহে ছিল কখন ঘোষণা আসবে। এরপর আমরা সংসদ ভবন থেকে রওনা হই, প্রথমে একটি সিএনজিতে উঠি এরপর ফার্মগেট থেকে হেঁটে বিকাল ৫টার পর চ্যানেল ২৪ পৌঁছাই। প্রথমে চ্যানেলটি সরাসরি লাইভে যেতে আগ্রহী ছিল না। তাদেরকে সংস্থা থেকে ফোন করছিল। এরপর তালাত মামুন ভাই রাজি হন। এরপর সেই ঐতিহাসিক লাইভ আটজন স্ক্রিনে আসেন। আমি, নাসির, মাহফুজ, রাফিসহ অনেকেই তখন ছিলাম ক্যামেরার পিছনে।

বাসস : আর ১৬ জুলাইয়ের ঘটনা?

আদীব : ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিকাল ৪টার দিকে আমি টিএসসি পৌঁছাই। সেখানে ছাত্রলীগের সমাবেশ চলছিল। অন্যদিকে শহীদ মিনার কয়েক হাজার (৪-৬ হাজার) শিক্ষার্থী অবস্থান নিয়েছে। শহীদ মিনারে পৌঁছেই আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার খবর তখন কনফার্ম হই। আসিফের সাথে কথা হলো, হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রস্তুত তারা যেভাবেই হোক রাজু ভাস্কর্যে যাবে। আমি তখন বিএনপির হাই কমান্ড, ভিপি নুরুল হক ও ছাত্রশিবিরের সাথে যোগাযোগ করি। যে শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার থেকে রাজু ভাস্কর্যের উদ্দেশ্যে গেলে যেন অন্যান্য দল বা সংগঠনগুলোও প্রস্তুত থাকে। রাজু ভাস্কর্যে তখন ছাত্রলীগের সশস্ত্র প্রস্তুতি। আমার যেহেতু সাংবাদিকতার পরিচয় ছিল তাই আমার দায়িত্ব ছিল রাজুতে গিয়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশের প্রস্তুতির খোঁজ রাখা। এসে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করা। আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর আসিফ মাহমুদ প্রথম আমাকে ভিডিও বার্তায় দিয়েছিলেন। যাই হোক পরবর্তীতে তারা হতাহত ও অন্যান্য চিন্তা করে সংঘর্ষ এড়িয়ে রাজু ভাস্কর্য যাননি। যদি আন্দোলনের নেতারা সে দিন রাজু ভাস্কর্যে যেতে পারতেন তাহলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। হয়তো এতো ২ হাজার শহীদ হতে হতো না। কারণ আন্দোলনের হেডকোয়ার্টার তখন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবি শিক্ষার্থীদের দখলে চলে আসলে ইতিহাস অন্যরকম হতো।

বাসস : রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও আপনি একজন মূলধারার গণমাধ্যমকর্মী। কখন কীভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়লেন?

আদীব : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মূলত আমার রোলটা ছিল নেপথ্যে ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মূল সোর্স হিসেবে। ৩ আগস্ট ঢাকা ট্রিবিউনে একটি নিউজ হয় যে আন্দোলনের পিছনে (একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে) “কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে একজন ‘ইন্টেলেকচুয়াল তরুণ’ গভীরভাবে আন্দোলনে যুক্ত” বলে তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক এই তরুণের সঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও দেশের খ্যাতনামা একজন চিন্তকের যুক্ততাও গভীরভাবে খুঁজে দেখা হচ্ছে।’ জাতীয় দৈনিকের সংবাদটিতে উল্লেখিত সাংবাদিক আমিই ছিলাম। ১৬ জুলাই যখন কঠোর দমনপীড়ন শুরু হয়। সেদিনই আবু সাঈদ শহীদ হন। তারপর তো ১৮/১৯ জুলাই যখন ইন্টারনেট সাটডাউন হয়, তখন মূল নেতৃত্বে যারা ছিল নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। ছাত্র অধিকারের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ওদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা ছিল। জুলাইয়ের সংবাদ দেশি মিডিয়াগুলো পাবলিশ করতো না। যেহেতু আমি গণমাধ্যমে জড়িত ছিলাম তাই আন্দোলনের সাংগঠনিক বার্তা বিদেশি মিডিয়াতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম।

বাসস : কোন কোন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সংবাদ পৌছাতে পারতেন?

আদীব : বিশেষ করে বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, আলজাজিরা, নেত্রনিউজের সাংবাদিকদের পৌঁছে দিতাম। এ ছাড়াও আরও কিছু মাধ্যমে আমরা নিউজ পাঠাতাম। আকবর ভাই, তানভীর ভাই, এহসান ভাই, হারুন ভাই, শফিক ভাই এদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হতো।

বাসস : শুনেছি নাহিদ ইসলামকে গুমের আগে সর্বশেষ আপনার সঙ্গে ফোনে কথা হয়? কিন্তু আপনি আটক হননি। কারণ কি?

আদীব : ঠিক বলেছেন। নাহিদ ইসলামকে যখন তুলে নিয়ে যায়, তার আগে সর্বশেষ আমার সঙ্গে কথা হয়। ফলে পুলিশ আমার নম্বর পেয়ে যায়। নাহিদ তখন গুম ছিল ওর পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে সংবাদ সম্মেলন করার আয়োজন চলছিল। একইসাথে নুরুল হক নুরও আটক হলে তার পরিবারের সাথেও কথা বলে সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির হল রুম বুকিং দিয়েছিলাম আমি। পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের পূর্বেই তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। নাহিদকে তুলে নিলে প্রথমে আমার কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু যেহেতু আমি সাংবাদিক তাই ১৯ তারিখই আমাকে তুলে নিয়ে যায়নি। তারা আমার অফিসের সম্পাদকের কাছে আমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়। অফিস থেকে চাকরিচ্যুত করার জন্য মালিকপক্ষ ও সম্পাদক শফি ভাইকে চাপ প্রয়োগ করে। এরপর আমাকে তিন বার গুম করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমবার ২২ জুলাই মিরপুরে আমার বাসায় ছদ্মবেশে পুলিশ যায়। এরপর ২৪ জুলাই বিবিসির অফিসের নিচ থেকে। সর্বশেষ ২৬ তারিখ ভোর ৪টায় আমার কর্মস্থলে চার গাড়ি যৌথবাহিনি অভিযান চালায়। যদিও আমি তখন ওখানে ছিলাম না। রাজনীতি করায় পূর্ব থেকেই পুলিশের হয়রানি সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতা ছিল যা কাজে লেগেছিল। ২২ তারিখের পর থেকে আর বাসায় থাকা হয়নি। সরকার শপথ নেওয়ার পর বাসায় ফিরি।

বাসস : নাহিদ ইসলামকে গুমের পর নির্যাতন করে রাস্তায় ফেলে যায়। তাকে কীভাবে উদ্ধার করেন?

আদীব : নাহিদকে গুম করার পর মেরে রাস্তায় ফেলে যায়। সে আমাকে ফোন করে বলে, ‘আদীব ভাই, আমাকে তো রাস্তায় ফেলে গেছে। এখন তো অসুস্থ, হাসপাতালে যেতে হবে, কোথায় যাওয়া যায়?’ তখন আমি গণস্বাস্থ্যের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওখানে চিকিৎসা চলতে থাকে। আমি সবসময় গণমাধ্যমের কাজগুলো করতাম। নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের কিছু ভিডিও নিই। তাদের সঙ্গে কী কী হয়েছে। ছবি তুলে রাখি। যেহেতু আমার গণমাধ্যম এটা পাবলিশ করবে না, তখন আমি কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা করছিলাম। কিন্তু তখন গোয়েন্দা পুলিশ আমার ফোন ট্রাকিং করছিল। আমার মনে আছে, ২৪ জুলাই আমি যখন বিবিসি অফিসের নিচে নামি। তখন আমার পেছন পেছন আসা মোটরসাইকেলের দুজন ব্যক্তিও আমার কাছাকাছি নেমে পড়ে।  ওরা ছবি বের করছিল। আমি যে আদীব ট্রেস করতে পারেনি হয়তো। আমি বুঝতে পেরে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে যাই। এরআগে তখন রাত সাড়ে ৯টা, ২২ জুলাই বোধ হয়। গুলশান এলাকায় কোনো মানুষজন নেই। থমথমে একটা অবস্থা। কোথা থেকে একটা অটো দ্রুত চলে আসে। আমি সেটাতে উঠে পড়ি। তারপর কোথা থেকে একটা মোটরসাইকেল যেন উড়ে এলো। ওই বাইকারকে আমি চিনি না। কিন্তু বললাম ভাই আমাকে হেল্প করেন। উনি যেন আমাকে রক্ষা করার জন্যই প্রস্তত ছিলেন! দ্রুত আমার অফিসে পৌঁছে দিলেন। এদিকে বাসা থেকে ফোন এলো যেন বাসায় না যাই। কারণ বাসার নিচে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ছদ্মবেশে আমার খোঁজ করছিল। আপনার ভাবিকে (নিশাত ফারজানা) বের হতে বললাম। অনেক রাতে তাকে তার মায়ের বাসায় রেখে আসি। আর আমি ফোন বন্ধ করে অন্য জায়গায় চলে যাই।

বাসস : এটা কি জুলাইয়ে পলাতক জীবনের শুরু?

আদীব : এটাই পলাতক অবস্থার শুরু। সম্ভবত ২২ জুলাই হবে। তখন থেকে আর বাসায় যেতে পারতাম না। পরের দিন অফিস করি। তখন আমাকে জানানো হয় যে, অফিসে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন এসেছিল। যেহেতু আপনি ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলেন তারা এ কারণে আপনাকে খুঁজতে পারে। আটক করতে পারে। ঝামেলা হতে পারে। বলা হয় আর অফিসে না আসতে। তবুও আবার আমি অফিস করতে শুরু করি। কিন্তু ২৬ জুলাই দুপুর ২টার দিকে ফের ৩ জন সমন্বয়ককে গণস্বাস্থ্য থেকে তুলে নেয়। অন্য ৩ জনকে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়। শুক্রবার দিবাগত রাত ৪টায় আমি অফিসে যাই। তখন সবাই আমাকে নিয়ে আলোচনা করছিল। তখন র‌্যাবের চারটা গাড়ি আমার ফোন ট্রাকিং করে অফিস রেট দেয়। কিন্তু যেহেতু বারতলা বিল্ডিং এর আন্ডার কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। তারা অফিসে গিয়ে নিচের দারোয়ানকে মারধর করে। তাদের উপরে নিয়ে যায়। তখন বুঝতে পারে এটা মিডিয়া-পত্রিকার অফিস। সিসিটিভি হার্ডডিস্ক নিয়ে চলে আসে। এভাবে রাতে দিনে পুলিশ র‌্যাব গোয়েন্দা সংস্থাসহ এজেন্সি থেকে আমাকে গুমের চেষ্টা চলে।

বাসস : আচ্ছা আন্দোলনের শুরু থেকে একটু বলুন…

আদীব : আন্দোলন তো শুরু হয় ৫ জুন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। ৬ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে। এই কর্মসূচিতে বহু শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

বাসস : ৯ জুন কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা?

আদীব : হ্যাঁ, ওই দিন শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেয় তারা। এ ছাড়া বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল সুপ্রিমকোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দিতে যায়।

বাসস: ১ জুলাই ফের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে?

আদীব : হ্যাঁ, ওই বিক্ষোভ থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহ্বান জানানো হয়। এ সময় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে একত্র হবেন বলে জানানো হয়।

বাসস : কিন্তু ২ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা রোড অবরোধ করে?

আদীব : ওই দিন আন্দোলনকারীরা নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাব টু বাটা সিগন্যাল হয়ে শাহবাগে যায়। সেখানে এক ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। তারই অংশ হিসেবে জাবি শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা রোড ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করে। এ ছাড়া ৩ জুলাই আন্দোলনকারীরা ঢাকার শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ করে। একই দাবিতে আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করে।

বাসস : তাহলে ৩ জুলাই ময়মনসিংহে রেললাইন অবরোধ করে কারা?

আদীব : ৩ জুলাই মূলত আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রেললাইন অবরোধ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে চট্টগ্রাম ও বরিশালের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ৪ জুলাই ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় তারা। ৫ জুলাই শুক্রবার ছুটির দিনও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। তারপর ৬ জুলাই সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে নতুন ঘোষণা আসে।

বাসস : ‘বাংলা ব্লকেড’ এই ধারণা কার মাথা থেকে আসে?

আদীব : আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সকলে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হতো। এটা সম্ভবত মাহফুজ আলমের দেওয়া। সবচেয়ে মজার বিষয় ‘বাংলা ব্লকেডে’ কিন্তু রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ে। তখন আমরা বুঝতে পারি দেশের মানুষের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এবং এ দিনই অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আসে।

বাসস : ৮ জুলাই নাহিদ ইসলাম এক বক্তব্যে বলেন, ‘বল এখন সরকারের কোর্টে। আদালত দেখিয়ে লাভ নেই। সরকারই ঠিক করতে পারে, এই আন্দোলনের গতিপথ কী হবে।’ তখনও কী এক দফার দিকে যাবে বলে আপনাদের মনে হয়েছিল?

আদীব : এদিন কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬৫ সদস্যের একটি সমন্বয়ক টিম গঠন করা হয়। তার মানে আন্দোলন যে দানা বাঁধতে ছিল সেটা নাহিদ-আসিফ-বাকেররা বুঝতে পেরেছিল। এ দিন নাহিদ আরও একটা দাবি তুলেছিল। সেটাও কিন্তু ১ দফার দাবি ছিল। সেটা ছিল সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করা।

বাসস: তারপর ১৪ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলন কীভাবে এগোলো?

আদীব : তারিখ ধরে ধরে আমি যদি বলি। সরকার যেমন গো ধরেছে। শিক্ষার্থীরা মাথা নত করেনি। এভাবে আন্দোলন এগিয়ে গেছে। যেমন ১০ জুলাই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না।’ তারপর ১১ জুলাই সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বলেন, “শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন।”

বাসস : ১০ জুলাই তো ওবায়দুল কাদেরও একটা বক্তব্য দেয়…

আদীব : হ্যাঁ। তারা সবাই উস্কানি দিচ্ছিলো। তিনি ধানমন্ডি অফিসে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি।। তারপরের দিন ১১ জুলাই শুক্রবারও শিক্ষাথীরা সারাদেশে আন্দোলন জোরদার করে। এ দিন সেই সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত বলেন, ‘বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই।’ আর ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে অপমান করে। সেই দিন রাতেই হল থেকে বেরিয়ে পড়ে তারা। এই জোয়ার আর থামাতে পারেনি কেউ।

বাসস : শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কীভাবে গণআন্দোলন হয়ে উঠলো? সে ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন?

আদীব : ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকালের কর্মসূচি দিয়ে শাহবাগ অবরোধ করা হয়। অবরোধের পরের দিন শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি। তখন আমরা টেনশনে পড়ে যাই। আন্দোলনের তখন টানিং পয়েন্ট। সরকার চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে পারে। এমন শঙ্কার মধ্যে ছিল নাহিদ-আসিফ-বাকেররা। ফলে সরকার দাবি না মেনে যদি হামলা-মামলার দিয়ে যায় তাহলে কি করা হবে। কিন্তু আপনি যদি খেয়াল করেন, ওইদিন নাহিদ ইসলাম কিন্তু ঘোষণা করেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা হলে আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। এমন কি হরতাল-অবরোধের ডাক দেওয়া হবে।’ যা পরবর্তীতে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা হয়।  হরতাল অবরোধ মানে কী? এটা তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ফলে হরতাল মানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের আহবান। তখন এটা আর ক্যাম্পাসের বা ছাত্রদের আন্দোলন থাকে না। তার এই বক্তব্যের মধেই কিন্তু গণআন্দোলনের ইশারা ছিল।

বাসস : ১৫ জুলাই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখে ছাড়বেন?

আদীব : তারপরই তো মূলত হামলাটা করা হয়। ওই হামলাটাই আন্দোলনকে গতিশীল করে। তারা ভেবেছিল শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে ও ভয়ে আর রাস্তায় নামবে না। পূর্বের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চেয়েছিল। ১৫ তারিখে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী আহত হয়। ঢামেকে গাজার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ছাত্রলীগ হাসপাতালে ঢুকে আহতদের উপর নির্যাতন করে। এদিন আমার উপরও ছাত্রলীগ হামলা করতে আসে। কিন্তু আগে থেকে আমি যেহেতু ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার ফলে ছাত্রলীগ আমাকে চিনতো। একই সঙ্গে আমি গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেওয়ার পর আইডি কার্ড চেক করে। অন্যান্য গণমাধ্যমের সহকর্মীরা আমাকে দেখে রাখে। তারপর তো ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ ৬ জন শহীদ হয়। দেশের মানুষ ফুসে ওঠে। সেদিনই গায়েবানা জানাজার ঘোষণা আসে।

বাসস : ১৭ জুলাই ঢাবির গায়েবানা জানাজায় ছিলেন? সে দিনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা শুনতে চাই। 

আদীব : গায়েবানা জানাজায় আমি ছিলাম। ওই দিন শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত পুলিশ ও ছাত্রলীগের দখলে ছিল। আমি, এহসান ভাই, রোমিও ভাই শাহবাগ দিয়ে যেতে পারিনি। আমরা মেট্টোরেলে উঠে টিএসসি নামি। সেখানে আকতার ছিল। কিন্তু পুলিশ কাউকে দাঁড়াতে দিচ্ছিলো না। তো একটা সময় আকতার রাজু ভাস্কর্যে শুয়ে পড়ে। সে বলে ক্যাম্পাস আমার, আমার ক্যাম্পাসে আমি থাকবো। আমারে মেরে ফেলেন, তবু আমি ক্যাম্পাস ছাড়বো না। তখন সব সাংবাদিকরা ওকে ঘিরে রাখে। এক ধরনের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সাংবাদিকদের ওপরই টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তো একটা সাউন্ড গ্রেনেড দেশ টিভি কিংবা চ্যালেন এস’র এক সাংবাদিকের গায়ে লাগে। আমি তার পাশেই ছিলাম। আমার গায়ে সরাসরি লাগেনি। তো সাংবাদিকরা সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করে। আর আকতারের সঙ্গে চার জন শুয়ে পড়ছিল। পুলিশ আকতারকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু বাকী তিনজনকে আমরা প্রেটেক্ট করলে আর তুলে নিতে পারেনি। এরপর আমরা ভিসি চত্বরের দিকে আগাই। ওই সময় প্রতীকী ছয়টি কফিন নিয়ে মিছিল রোকেয়া হলের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তখন পুলিশ ব্যাপক হামলা চালায়। পুলিশ টিয়ারসেল, জলকামান, টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ে। পুলিশ যাকে পায় তাকেই মারে। ওই দিন আর দাঁড়ানোর কোনো অবস্থা ছিল না। কারণ টিয়ারগ্যাসে চোখ খোলা যাচ্ছিল না। রুমাল টিসু দিয়ে যার যার মতো চোখ বন্ধ করে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। যে যে দিকে পারে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কফিনও পড়ে থাকে রাজপথে। সেই ছবি কিন্তু ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তবু মাঠ ছাড়ে না। তারা ভিসি চত্বরের দিয়ে যায়। এরপর পুলিশ কিন্তু ক্যাম্পাসে নজিরবিহীন হামলা করে। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে। অনেক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়, আহত হয়।

বাসস : ওইদিন তো হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমরা ভিসি চত্বরের রাস্তায় বসে পড়ে?

আদীব : হ্যাঁ ওইদিন। রোকেয়া হলের সামনে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করার পর এক দফা হামলা-মারধর হবার পর তেমন আর শিক্ষার্থীরা ছিল না। কিন্তু ওরা দুজন সাহস করে রাস্তায় বসে পড়ে। আরও কয়েকজন ছিল। এটা বোধহয় সন্ধ্যার আগে আগে। তো যেটা বলছিলাম। পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢোকার পর আমরাও ক্যাম্পাসে ভেতরে ঢুকি। কারণ অনেক ছাত্র তখন ক্যাম্পাসে। তো হল পাড়া বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে যাই। ওখানেও পুলিশ খুব বাজেভাবে হামলা করে। ওই সময় ১৭ তারিখ হান্নান মাসুদের সারা শরীরে শখানেক ছররা গুলি লাগে। সে আহত হয়।

বাসস : হান্নান মাসুদের যে ছবিটা আসিফ নজরুল স্যার পোস্ট করছিলেন? প্যান্টের দুই পায়া ছেঁড়া, হাতে পানি, গায়ে গুলির চিহ্ন দেখা যায়?

আদীব : জ্বি। ওই ছবিটা। তখন ওকে আমরা কীভাবে উদ্ধার করব ভাবতেছিলাম। কারণ আমরা ওকে নিয়ে মল চত্বরের দিকে এগিয়ে দেখি নীলক্ষেতে ছাত্রলীগ। রাজু ভাস্কর্যে পুলিশ। শাহবাগ অবরুদ্ধ। কোনোভাবে কয়েকজন মিলে তাকে রেসকিউ করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর পরের ঘটনা তো আপনার জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়িত করে ‘ছাত্রলীগমুক্ত’ ঘোষণা। ঢাবি থেকে ছাত্রলীগের বিতাড়ন ছিল আন্দোলনের অর্ধেক বিজয়। এমন ইতিহাস তো এর আগে কখনো ঘটেনি।

বাসস : তারপর ১৮ জুলাই আপনি কোথায় ছিলেন?

আদীব : পরদিন তো সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। এদিন আমি মিরপুরে দিলাম। মিরপুর ১০ চত্বরে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। এবং দুপুর ২টার আগেই ছাত্রজনতা মিরপুর ১০ এর আশেপাশের সব এলাকা তাদের দখলে নিয়ে নেয়। পুলিশ শুধু মিরপুর ২ এর থানার সামনে অবস্থান নিতো। আর ১১ এর পরে পুলিশ-বিডিআর-আর্মি থাকতো। এদিকে ওইদিন তিনটার দিকে কাজীপাড়ায় হেলিক্যাপ্টার দিয়ে গুলি ছোঁড়া হয়। শেওড়াপাড়ায় হাসপাতালে নেওয়ার আগে এক শিক্ষার্থী শহীদ হলে সেই লাশ নিয়ে তারা মিরপুর ১০ দিকে রওনা হয়। উপর থেকে হামলা করে র‌্যাব আর নিচে হামলা করে পুলিশ। এদিন মিরপুর এলাকায় রাত ১০টার দিকে পুলিশ গলিতে গলিতে ঢুকে গুলি করা শুরু করে। এমন কি মানুষের বাসায় গিয়ে গুলি চালায়। আমি রাত সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১০-এ যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পুলিশ-বিডিআর-আর্মি আমাকে যেতে দেয় না। অবস্থা খুব বেগতিক ছিল।

বাসস : ওইদিন তো মিরপুরে পুলিশের গুলি বাসার জানালা ভেদ করে সামির নামে এক শিশু শহীদ হয়?

আদীব : না। ওটা মনে হয় পরের দিন ১৯ জুলাই। মিরপুরে কাফরুল থানার সামনের ঘটনা। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিল ঘরে। শিশুটি জানালা বন্ধ করতে গেলে একটা গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়!

বাসস : সেই গুলিটা তার বাবা নাকি চাচার কাঁধে গিয়ে লাগে?

আদীব : একদম। ঘরে তার চাচা ছিল। তার কাঁধে গিয়ে লাগে।

বাসস : তারপর বলেন…

আদীব : রাতে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইন্টারনেটসেবা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকালে মানে ১৯ জুলাই নাহিদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়।

নাহিদ আমাকে ফোন করে বলে, ‘ভাই অনেক লোক তো মারা গেল। গণমাধ্যম আমাদের বক্তব্যও নিচ্ছে না। কি করা যায়?’ আমি আর এহসান ভাই ওইদিন ঢাকা মেডিকেলে মর্গে যাই। মর্গে যে লাশগুলো আসছিল। তাদের তথ্য নিই। ১৭/১৮ জন লাশের তথ্য পাই। এবং তখনও বিভিন্ন জায়গা থেকে লাশ আসতে থাকে। এরপর রাতেও নাহিদের সঙ্গে কথা হয়। কোন ধরনের কর্মসূচি নেওয়া যায়? সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মুশকিল হয়ে যায়। তখন আমি বলি শোক মিছিল করা যেতে পারে, এবং শুক্রবার জুম্মার পর নাহিদ যে বক্তব্য দেয় আমরা কয়েকটি গণমাধ্যমে পাঠাই। আমি নিজে তিন/চারটি মিডিয়ার সিইও’র সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো নিউজ ছাপেনি। তখন আবার কথা হয় নাহিদের সাথে। তো ৯ দফা ঘোষণার পরই কিন্তু ১৯ জুলাই রাত দেড়টার দিকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয় এবং একই দিনে নুরুল হক নুর, রুহুল কবির রিজভীকে তুলে নেওয়া হয়।

বাসস : তারপর তো ২৬ থেকে ২৯ জুলাই দ্বিতীয় দফায় আবারও নাহিদ ইসলামসহ ৬ জনকে তুলে নেওয়া হয়? এই সময়ে আন্দোলন কর্মসূচি কীভাবে পরিচালিত হতো?

আদীব : এ সময়গুলোতে আন্দোলনের দ্বিতীয় ফেইসে নেতৃত্ব ছিল। বিশেষ করে হান্নান মাসুদ, রিফাত রশীদ ও মাহিন সরকারের একটা মুষ্টিবন্ধ হাত তো সবার মুখস্ত। এ ছাড়া আব্দুল কাদের ছিল। তাদেরকে নিরাপদে একটা স্থানে রাখা হয়। তাদের সঙ্গে আমারও থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরে আর যাওয়া হয়নি।

বাসস : আন্দোলন যে সরকার পতন বা এক দফার দিকে যাচ্ছে কবে মনে হলো?

আদীব : এটা ১ তারিখে বুঝতে পারলাম। কারণ ৩১ তারিখে আমরা তো লাল প্রফাইলের ঘোষণা দিলাম। কারণ তারা শোকের কালো ব্যাচ ধারণের ঘোষণা করেছিল। ফলে লাল শ্রাবণ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিপ্লব হয়েই যায়। এটা ভালো প্রভাব ফেলেছিল। ১ তারিখে নাহিদের সঙ্গে আরও কথা হয়। তখন আমরা এক দফার কথা ভাবছিলাম। কি করা যায়? এক দফা ঘোষণা দেওয়া মানেই তো একটা ফাইনাল ডিসিশনে যাওয়া। কিন্তু আন্দোলন সফল না হলে তো ফাঁসির কাষ্টে ঝুলতে হবে। পুরো জাতি পরাজিত হবে। তারপর দেখলাম বাংলামোটরে বৃষ্টির ভেতরে আপনারা বিক্ষুব্ধ কবি লেখক এবং ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে শিল্পী সমাজের ব্যানারে বিশাল প্রতিবাদী র‌্যালী অনুষ্ঠিত হয়। ফলে আমরা সাহস পাই। ৩ তারিখে আমরা সিন্ধান্ত নিই যে, এক দফার ডাক দিতে হবে। পরের দিন দ্রোহের যাত্রায় শহীদ মিনারে নাহিদ ইসলাম কিন্তু ১ দফা ঘোষণা দেয়। কিন্তু আমরা চিন্তায় ছিলাম; মানুষ ৪ তারিখে মাঠে নামবে কিনা? সব ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে মানুষ ৪ আগস্টও মাঠে নেমে আসে। এটাই গণআন্দোলন। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী থেকে হিজড়া সবাই মাঠে নেমেছে।

বাসস : ৪ আগস্ট আন্দোলনের একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সেদিন কোথায় ছিলেন?

আদীব : চার তারিখে আমি খুব রিস্ক নিয়ে শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হই। কিন্তু কাওরান বাজার পার হওয়ার সময় দেখি একদল সাংবাদিক ফোয়ারা চত্বরে সরকারের পক্ষে মানববন্ধন করছে! সেই সময় তো বেশিরভাগ সাংবাদিক সরকারের তাবেদারি করেছে। ফলে তাদের মুখোমুখি হই। ছবি তুলতে পারি না। কারণ তারা আমাকে আন্দোলনের পক্ষের হিসেবে চেনে। ফলে আমি রিস্কে ছিলাম। তারা আবার আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় কি না? শাহবাগে গিয়ে দেখি মাঠ ছাত্রলীগ-যুবলীগের দখলে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন একটা বড় মিছিল বের হয়ে শাহবাগের দিকে আসতে দেখলো। তারা পিজি হাসপাতালের ভেতর ঢুকে গেল। এবং হাসপাতালের গাড়ি, এ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটে আগুন দেওয়া শুরু করলো। তার মানে তারা আগুনটা যে শিক্ষার্থী বা আন্দোলনকারীরা দিয়েছে এটা প্রচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো থাকার কারণে তাদের আগুন লাগার ছবি ও ভিডিও মিডিয়াগুলোতে চলে আসে। একটু পরে বাংলা মোটর, কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে এবং পুলিশ ব্যাপাক গুলি চালায়। এদিকে তখন নাহিদ ইসলাম ও আন্দোলনের নেতারা তখন শাহবাগে চলে আসে এবং একটা বক্তৃতা দেয়। বলে, যদি আমাদের ওপর আর কোনো নিপীড়ন চলে আমরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হবো।

বাসস : পরশু নয় আগামী কালই লং মার্চ টু ঢাকা। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয় কেন এবং কী কারণে?

আদীব : এটা ৪ তারিখ রাত ১১টার দিকে আলোচনা করে ঘোষণা করা হয়। তখন আমরা ভাবছিলাম যদি সরকার পালিয়ে যায় তখন কি হবে? সে সব কথা তো আপনাকে শুরুতেই বলেছি।

বাসস: জুলাইয়ে আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছেন? বিশেষ করে ৫ তারিখে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন?

আদীব: যেহেতু আগেও রাজনীতি করেছি। ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতাম। যোগাযোগ রাখতাম। সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত আমি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ছিলাম। জাতীয় সরকারের বিষয়ে এহসান মাহমুদের মাধ্যমে তারেক রহমানের সাথে জাতীয় সরকার নিয়ে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছিল- যে কোনো সরকারের চেয়ে জাতীয় সরকারই বেটার। কিন্তু বিএনপি অনীহার কারণে সেটা হয়নি। যদি জাতীয় সরকার হতো তাহলে কিন্তু আজ এত দ্বন্দ্ব থাকতো না। এত সংকট তৈরি হতো না।-বাসস


এই ক্যাটাগরির আরও সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর