বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫, ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন

‘আজ পুলিশ আত্মসমর্পণ করবে, আজ যেতেই হবে’ : শহীদ ইয়াহিয়া আলী

নিউজ ডেস্ক | মেট্রোটাইমসটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট : মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫, ১২:৪২ পূর্বাহ্ন

নিয়মিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন ইয়াহিয়া আলী। এদিকে আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র থেকে তীবর্তর হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আত্মসমর্পণ করে। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার এনায়েতপুরেও পুলিশ আত্মসমর্পণ করবে বলে শোনা যাচ্ছিল। তাই স্ত্রী অসুস্থ হলেও এমন দিনে আন্দোলনে না গিয়ে থাকতে চাননি ইয়াহিয়া।

ইয়াহিয়ার স্ত্রী শাহানা বলেন, ‘সেইদিন আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। তাই ওকে বলি, ‘আমি খুব অসুস্থ, তুমি আজ আন্দোলনে যাইও না। ও বলে না এতদিন আন্দোলনে গেলাম, আজ পুলিশ আত্মসমর্পণ করবে, আজ যেতেই হবে। আজ আর গোলাগুলি হবে না। তুমি কষ্ট করে রান্না করে রেখো, আমি এসে খাবো।’

কিন্তু বাড়ি ফিরে স্ত্রীর রান্না আর খাওয়া হয়নি তার। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকাল সকাল ৮ টার আন্দোলনে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হন ইয়াহিয়া। আন্দোলনে গিয়ে এনায়েতপুর থানার সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি।

বন্ধুদের বরাত দিয়ে ইয়াহিয়ার স্ত্রী বলেন, ‘এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে সেদিন মিছিল নিয়ে এনায়েতপুর থানার সামনে যায়। সেখানে তারা মিছিল করতে থাকে। তখন সেখানে পুলিশ তাদের মিছিলের ওপর গুলি চালায়। রাজপথ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সেই সময়ে একটি বুলেট এসে লাগে ইয়াহিয়া আলীর ডানপাশের পাঁজরে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। রক্তে চারপাশ ভেসে যায়। আন্দোলনকারীরা তাকে স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরে রাত ১২ টার দিকে প্রতিকূল অবস্থায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার মরদেহটিও গ্রামের আটার দাগ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার এনায়েতপুরের খুকনি ঝাউপাড়া গ্রামে বৈদ্য জামতৈল এলাকার প্রামানিক পাড়া গ্রামের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এসব কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মো. ইয়াহিয়া আলীর স্ত্রী শাহানা খাতুন (২৮)।

সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করা পাশাপাশি, শহীদ ইয়াহিয়ার স্বপ্ন ছিল একটি পাকা বাড়ি নির্মাণের। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার আগেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট দুপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী।

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শহীদ ইয়াহিয়ার ছিল সুখের সংসার। ইয়াহিয়া ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দিন আনি দিন খাওয়া পরিবারের কর্তাব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দৈন্যদশায় পড়েছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তার স্ত্রী এখন তাঁতকলে কাজ শুরু করেছেন।

শহীদ ইয়াহিয়া ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর এনায়েতপুরের খুকনি ঝাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মো. শাজাহান আলী (৭২) ও মা মোছাম্মৎ চামেলী খাতুন (৬২)। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে ইয়াহিয়া ছিলেন সপ্তম। শহীদ ইয়াহিয়া বাবা ও ভাইয়ের সাথে তাঁতকলে কাজ করতেন। বিগত প্রায় ২০ বছর যাবত তিনি এ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।

সালমান নামে ১৩ বছরের একটি ছেলে এবং তাইবা খাতুন নামে ৮ বছরের একটি মেয়ে রয়েছে তাদের। বাবার স্বপ্ন পূরণে সালমানকে রাজধানী ঢাকার একটি মাদ্রসায় ভর্তি করা হয়েছে। মেয়ে তাইবা স্থানীয় একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে।

শাহানা খাতুন বলেন, ‘২০১১ সালের ৩১ জুলাই পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়। পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল না। আমার স্বামী তাঁত শ্রমিকের কাজ করতা। তা থেকে যা আয় হত তা দিয়ে কোনোরকমে আমাদের সংসার চলত। তারপরও ছেলে-মেয়ে ও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে আমাদের ছিল সুখের সংসার।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘কিন্তু সেই সুখ আমার ভাগ্যে বেশি দিন সইল না। ছেলে-মেয়ে দুইটাকে এখন কীভাবে মানুষ করবো সেই চিন্তা করি। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে আলেম ও মেয়েকে ডাক্তার বানানোর। জানি না সেই স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে।’

শাহানা খাতুন বলেন, ‘ আমাদের কোন জমি-জমা নেই। আমার স্বামী মারা যাবার সময় কিছু ঋণ রেখে গেছেন, সে ঋণ কীভাবে পরিশোধ করব তাই নিয়ে চিন্তায় আছি।’

পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁত শ্রমিকের কাজ করে মাসে ইয়াহিয়া প্রায় ছয় হাজার টাকা ইনকাম করতেন। এই কাজ স্থায়ী নয়। তাই কাজ বন্ধ থাকলে মাসিক আয়ও বন্ধ হয়ে যেত। মাঝে মাঝে দুই তিন মাসের জন্যও কাজ বন্ধ থাকে। তাদের বসবাসের ঘরটিও একটি খুপড়ি ঘর। ছোট্ট একটি বিল্ডিং তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন, এখন সেটাও টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।

শহীদ ইয়াহিয়ার চাচা আলী আকবর বলেন, ইয়াহিয়া আমার ভাতিজা। সে খুবই ভালো মানুষ ছিল। সে তাঁত কলে কাজ করে সংসার চালাত। ৪ আগস্ট সে আমাদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। পরে দুপুরের দিকে এনায়েতপুর থানার সামনে পুলিশের গুলি শহীদ হয়।

ইয়াহিয়ার বড় ভাই খোকন আলম বলেন, আমার ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। তাতে আমরা গর্বিত। কিন্তু এই পরিবারের সেই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন সংসারের খরচকে জোগাবে? ওর ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচই বা কে দেবে? কে থাকবে ওদের পাশে? আমিও তাঁত কলে কাজ করি। যা আয় করি তা দিয়ে নিজের সংসার ঠিক মত চলে না, ওর পরিবারকে কিভাবে সহযোগিতা করবো?

এ সময় তিনি তার ভাইকে শহীদি মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করে বলেন, আমি ভাই হত্যার বিচার চাই। আর আমার ভাইয়ের একটি ছেলে ও ছোট একটি মেয়ে আছে। তাদের যেন সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়। যাতে পড়াশোনা করে ইয়াহিয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

শহীদ ইয়াহিয়ার বাবা শাজাহান আলী বলেন, আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।

ভবিষ্যতে আর কোন স্বৈচার যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে এমন ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সালে এসে আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারাদেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমার একটি স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে না পারে। আবার যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের আওয়তায় আনতে হবে।

নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে যেন শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শুধু মুখে শহীদ বললে হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। একই সাথে এই আন্দোলনে সারাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসন করার দাবি জানান শহীদ ইয়াহিয়ার বাবা।

কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ইয়াহিয়ার স্ত্রী বলেন, ‘জুলাই ফাইন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি। এছাড়াও বিএনপি, জেলা প্রসাশক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আমাদের সাথে দেখা করে পরিবারের খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন।

ইয়াহিয়ার মা চামেলী খাতুন বলেন, আমার ছেলে তো লেখাপড়া করে না, তেমন করেনি। ছোট থেকেই বাবা ও ভাইদের সাথে সে তাঁতশ্রমিকের কাজ করে। সে কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিল না। আমার ছেলেকে কেন এভাবে গুলি করে মেরে ফেললো?  আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।

তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী নিহতের ঘটনায় ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট নিহত ইয়াহিয়া আলীর স্ত্রী শাহানা খাতুন বাদী হয়ে ৮৬ জনের নামে এনায়েতপুর থানায় একটি হত্যার মামলা দায়ের করেন।-বাসস


এই ক্যাটাগরির আরও সংবাদ
এক ক্লিকে বিভাগের খবর